গোলাম মোহাম্মদ কাদের

প্রকাশিতঃ যুগান্তর, ১৪ জুলাই ২০২১

দেখতে দেখতে পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অনন্তযাত্রার দুটি বছর গত হয়ে গেল। সময়ের পরিক্রমায় একেবারে কম নয়। কিন্তু আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারছি না সফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু আলহাজ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে।দেশের শ্রেষ্ঠ সংস্কারক, সুদক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, দেশ গঠনের প্রয়োজনে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, দেশের লাখো কোটি মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিটিকে। সর্বোপরি, আমি কোনোভাবেই স্মৃতির আড়াল করতে পারি না পিতৃতুল্য আমার বড় ভাইকে।সব সময় মনে হয় তিনি আমার কাছাকাছি আছেন। চোখের সামনে সোম্য অবয়বের মানুষটি অগাধ ব্যক্তিত্ব নিয়ে বসে আছেন। তার শেষ সময়টার দুর্বিষহ মুহূর্তগুলো এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। হাসপাতালের শয্যা পাশে দাঁড়িয়ে যখন তার চোখের দিকে তাকাতাম-মনে হতো, কত কথা যেন বলতে চাচ্ছেন; অথচ আমি বুঝতে পারছি না। বুকের ভেতর চাপা কান্নাগুলো আটকে রেখে বলতে চাইতাম- ভাই, আর একবার আমাকে ‘সেলিম’ বলে ডাকো।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই ভোরবেলা। বছর ঘুরে এ সময় ও তারিখটা আসতেই থাকবে; আর বুকের ভেতরে আবার দৃশ্যপটে উঁকি দেবে অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো। দেশের সঠিক ইতিহাস লিখতে গেলে তার সম্পর্কে লিখতেই হবে। তার কীর্তি ও কর্ম এ দেশের মানুষের মণিকোঠায় আসন গেড়ে বসে আছে। সময় চলে যাবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে; কিন্তু ইতিহাস জানিয়ে দেবে এ মানুষটির কথা; যিনি পেয়েছিলেন মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, যার বিনিময়ে তিনি দেশকে সাজিয়ে দিয়েছেন উন্নয়ন-সমৃদ্ধি আর সংস্কারের তুলি দিয়ে।যেখানেই দুঃখ কষ্ট দেখেছেন, সেখানেই তিনি তার সবটুকু দিয়ে মানুষকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেছেন-ক্ষুধায় যন্ত্রণায় দু’মুঠো খাবারের আশায় কোনো মানুষ কাঁদে কি না; কনকনে শীতে পরিধেয় বস্ত্রের জোগান হয়েছে কি না; রোগ-ব্যাধিতে তাদের জুটছে কি না ওষুধ ও পথ্য। কৃষক তার লাঙলের ফলা থেকে তুলতে পারছে কি না সোনার ফসল; শ্রমিক তার শ্রমের হাত দুটোকে অকেজো বসিয়ে রাখছে কি না-এসব দিকেই ছিল পল্লীবন্ধুর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সেই মানুষটিকেও নিয়মের অমোঘ বিধানে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। তাই ভুলব কী করে শোকগাথা?বিরামহীন পথিকের মতো তিনি পথ চলতেন; দুরন্ত সাগরে সাহসী নাবিকের মতো পাল তুলে চলার চেষ্টা করতেন। তার ব্রত ছিল, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শত সহস্র কাজের মাঝে ছুটে যেতে হবে। আগামী দিনের আশার সূর্যকে তার জাগ্রত করতে হবে; কঠিন বাস্তবের সঙ্গে বিজয়ের জন্য তাকে লড়াই করতে হবে; নতুন বাংলাদেশ গড়ার দীপ্ত শপথ নিয়ে তাকে এগিয়ে যেতেই হবে। এই তো ছিলেন আমাদের প্রাণের একান্ত ভালোবাসার মানুষ পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার মতো নেতাকে কি কেউ সহজে ভুলতে পারে!পল্লীবন্ধু এরশাদকে নিয়ে অকথিত কথা বলতে কিছু নেই। তার জীবন ও কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রেরণা নেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। তিনি একজন মেধাবী সেনাপ্রধান, সুযোগ্য প্রশাসক, সফল রাষ্ট্রনায়ক, বাস্তববাদী সংস্কারক এবং একজন নির্যাতনভোগী রাজনীতিক ছিলেন। এতটা দিক পার হয়ে এসে তিনি ছিলেন পোড় খাওয়া এক জননেতা। আবার এতকিছুর মাঝেও তিনি ছিলেন একজন কবি।আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন একজন ভালো মনের মানুষ, যার ছিল এক বিশাল হৃদয়; যে হৃদয় দিয়ে তিনি উপলব্ধি করতে পারতেন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-হাসি-কান্না-আনন্দ-সুখ-সৃষ্টি-উল্লাস-ব্যথা-বেদনা-প্রেম-ভালোবাসা ও লীলাময় প্রকৃতির বিচিত্র অনুভূতি। তার ছিল বর্ণময় জীবন ও জীবনের অপূর্ব দর্শন। সে দর্শনের একটি দিক হচ্ছে, রাজনীতির কঠিন-জটিল অঙ্কের সরল সমাধান। ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার মতো তিক্ততা ও মিষ্টতার সমন্বয় ঘটানোর অভিজ্ঞতা।একজন রাজনীতিক কিংবা একজন রাষ্ট্রনায়কের সফলতা সেখানেই, যেখানে তিনি গতানুগতিক ভাবধারা অথবা ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থার বিপরীতে দেশ ও জনগণের মঙ্গলার্থে সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিক ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে পারেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এটা আজ দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-সংস্কারের ব্যাপারে পল্লীবন্ধু এরশাদের সফলতার সমান্তরাল এখন পর্যন্ত কিছু নেই।পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৯ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এ দীর্ঘ সময় অনেক কাজ তিনি করেছেন। যত বেশি কাজ, তার মধ্যে ততবেশি ভুলত্রুটি থাকতেই পারে।

কাজ না করলে ভুলের আশঙ্কা থাকে না। পল্লীবন্ধু এরশাদ তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য যতটা না স্মরণীয় হয়ে আছেন; তার চেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে আছেন তার সংস্কার কাজের জন্য; বিশেষ করে উপজেলা ব্যবস্থা। স্বাধীনতার স্বাদ ও গণতন্ত্রের সুফল এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী পল্লীবাসী মেহনতি কৃষক জনগণের দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণে উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তন ছিল পল্লীবন্ধু এরশাদের একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী তাদের সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের স্বার্থে এ দেশে পুলিশি শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে। ব্রিটিশ শাসনাবসানের পর পাকিস্তানের ২৫ বছর এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আরও ২৫ বছর ব্রিটিশ যুগের ওই পুলিশি প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু ছিল। পল্লীবন্ধু এরশাদই গোলামি যুগে প্রতিষ্ঠিত সেই ব্যবস্থাটি ভেঙে দিয়ে উপজেলা ব্যবস্থা চালু করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। উপজেলা ব্যবস্থা এখন এ দেশের বাস্তবতা। এ ব্যবস্থা মুছে দেওয়ার সাধ্য আর কারও নেই।যদিও তার প্রবর্তিত উপজেলা পদ্ধতিতে পরে মৌলিক কিছু পরিবর্তন এনে এর মুখ্য উদ্দেশ্যগুলোয় ব্যাপক ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে-যেমন, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের অধীনে উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সব সরকারি বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদের অর্পণ বাতিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে ‘তৃণমূল পর্যায় থেকে জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার অধিকার’।এছাড়া দেশের গ্রামাঞ্চলে শহরের সুযোগ-সুবিধা-যেমন, উপজেলা পর্যায়ে কোর্ট-কাচারি স্থাপনের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে গ্রাম পর্যায়ে শহরের সুবিধাদি প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্য।

জাতীয় পার্টি সর্বদাই এরশাদ প্রবর্তিত উপজেলা পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দাবি করে আসছে।পল্লীবন্ধু এরশাদের দেওয়া দায়িত্ব মাথায় নিয়ে এখন আমার অবিরাম পথচলা। তার দেখানো পথ এখন আমার পাথেয়। তিনি রেখে গেছেন সীমাহীন কর্মপরিধি। সেই কর্ম সম্পাদনে আমি এখন ক্লান্তিহীন এক কর্মী। পল্লীবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন, তার প্রতিষ্ঠিত প্রাণের সংগঠনকে সুসংগঠিত করে এ দেশ এবং দেশের জনগণের কল্যাণ করা। জীবদ্দশায় সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। তারপরও থেকে গেছে কিছু অসমাপ্ত কাজ।সেই অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব আজ আমার কাঁধে। পল্লীবন্ধুর সব স্বপ্ন আমাকে সফল করতে হবে। তার ছবি শুধু আমার দেওয়ালে নয়; বাঁধানো আছে আমার মনের ফ্রেমে, যেখান থেকে প্রতিনিয়ত নির্দেশ আসে-‘আমার দেওয়া দায়িত্ব তোকে পালন করতে হবে অক্ষরে অক্ষরে।’ তার নির্দেশ তো আমাকে পালন করে যেতেই হবে; যতক্ষণ আমার দেহে থাকবে একবিন্দু বহমান রক্ত।

গোলাম মোহাম্মদ কাদের : চেয়ারম্যান, জাতীয় পার্টি

error: Content is protected !!